কি খাওয়ালে মুরগির ওজন বাড়ে?

কি খাওয়ালে মুরগির ওজন বাড়ে? মুরগির মাংস খেতে কে না ভালোবাসে। শুধু স্বাদের জন্য নয় মুরগির মাংস প্রানীজ প্রোটিনেরও একটি বড় উৎস হওয়ায় গ্রাম থেকে শহর সব জায়গায় মুরগির সমান চাহিদা রয়েছে। তাই দিন দিন আমাদের দেশে মুরগির খামারির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মুরগি লালন পালনের ক্ষেত্রে একজন খামারির প্রথম যেটা জানার বিষয় তা হল কি খাওয়ালে মুরগির ওজন বাড়ে?

খামারি হিসেবে আমরা সবাই চাই আমাদের দেশি, সোনালি, ফাউমি, ব্রয়লার মুরগির ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পাক যাতে ব্যবসা লাভজনক হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মুরগির ওজন বাড়ানো সহজ প্রক্রিয়া নয়। কেননা খাদ্য প্রদানে কোথাও ভুল হলে মুরগির ওজন বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। শুধু তাই নয়, মুরগি মারাও যেতে পারে। তাই আজকে আমরা স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কি খাওয়ালে মুরগির ওজন বাড়ে তা নিয়ে আলোচনা করবো। চলুন তাহলে শুরু করি।

কি খাওয়ালে মুরগির ওজন বাড়ে

সোনালি মুরগির ওজন বৃদ্ধির উপায়?

বর্তমানে খামারিদের মধ্যে সোনালি মুরগির লালন পালন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর কারন হল এটি বেশ লাভজনক ব্যবসা। আপনি যদি ভালো মানের বাচ্চা, সঠিক ভ্যাকসিন ও মেডিসিন, এবং উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করতে পারেন তাহলে সোনালি মুরগি পালনে যথেষ্ট লাভবান হতে পারবেন। তবে এগুলোর বাইরেও আপনার খামারের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা উন্নত হতে হবে।

আপনি হয়ত ভাবতে পারেন উন্নত মানের বাচ্চা সংগ্রহ করলেই হবে অথবা বাচ্চার কোয়ালিটি যেমনই হোক, ফিড ভালো হলেই বাচ্চার গ্রোথ ভালো হবে। তবে এটা সঠিক নয়। সোনালি মুরগির ওজন বৃদ্ধির জন্য বাচ্চার কোয়ালিটির সাথে এদের দেয়া উন্নত ফিড, খামারের ভালো পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা সব কিছুই নির্ভর করে। যাইহোক, চলুন সোনালি মুরগির ওজন বৃদ্ধির একটি তালিকা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বয়স অনুপাতে খাবার প্রদানের তালিকা

  • ১ সপ্তাহ বয়স- ৫৫ গ্রাম ফিড
  • ২ সপ্তাহ বয়স- ১৪৮ গ্রাম ফিড
  • ৩ সপ্তাহ বয়স- ৩৩৮ গ্রাম ফিড
  • ৪ সপ্তাহ বয়স- ৫১৫ গ্রাম ফিড
  • ৫ সপ্তাহ বয়স- ৬৮৮ গ্রাম ফিড
  • ৬ সপ্তাহ বয়স- ৯৮৮ গ্রাম ফিড
  • ৭ সপ্তাহ বয়স- ১২৮৫ গ্রাম ফিড
  • ৮ সপ্তাহ বয়স- ১৬১০ গ্রাম ফিড
  • ৯ সপ্তাহ বয়স- ১৮৭৫ গ্রাম ফিড

সোনালি মুরগির ওজন স্বাস্থ্যকর উপায়ে বৃদ্ধির জন্য উপরে উল্লেখিত উপায়ে ফিড সরবরাহ করতে হবে। ভালো মানের ফিড প্রদানের পাশপাশি বাচ্চার সঠিক যত্ন নিতে পারলে অবশ্যই সোনালি মুরগির ওজন বৃদ্ধি পাবে।

ডিম পাড়া দেশি মুরগির খাবার তালিকা

ডিম পাড়া দেশি মুরগির খাবার তালিকা অন্য মুরগির চেয়ে কিছুটা ভিন্ন কেননা, ডিম পাড়া মুরগির পুষ্টির চাহিদা বেশী থাকে। ডিম পাড়ার কারনে শরীর থেকে প্রচুর পরিমানে ক্যালসিইয়াম বের হয়ে যায় তাই এই সময় মুরগিকে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। এছাড়াও মুরগিকে সুস্থ রাখার জন্য সুষম খাবারও দিতে হবে যেমন গম, ভুট্টা, নারিকেলের খৈল, সরিষার খৈল, ঝিনুক গুড়া, শুটকী মাছ গুড়া, লবন ইত্যাদি। কেননা মুরগি পরিপূর্ন পুষ্টি না পেলে ওজন কমে যাবে, ডিম পাড়া কমে যাবে, এমনকি নানারকম রোগেও আক্রান্ত হতে পারে।

ডিম পাড়া দেশি মুরগির ৫০ কেজি খাবার তালিকা

ডিম পাড়া দেশী মুরগির খাবার তালিকা তৈরির সময় আমারা অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভূক্ত করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। দেশি মুরগির ডিম এবং মাংস উভয়ের দামই বর্তমান বাজারে অনেক বেশি। তাই এই মুরগি পালন ভালো হলে অধিক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আমরা এখানে দেশি ডিম পাড়া মুরগির ৫০ কেজি খাবার বানানোর তালিকা তৈরি করে দেখাবো। আমাদের যা যা প্রয়োজন তা হলঃ

  • ২৩ কেজি ধানের গুড়া
  • ১০ কেজি ভাঙ্গা গম
  • ১০ কেজি ভাঙ্গা ভুট্টা
  • ২.৫ কেজি সরিষার খৈল
  • ২.৫ কেজি নারিকেলের খৈল
  • ১ কেজি শুটকি মাছের গুড়া
  • ১ কেজি ঝিনুক গুড়া
  • ২৫০ গ্রাম লবন

খাবার তৈরির পদ্ধতিঃ

  • মুরগির খাবার তৈরির আগে গম ও ভুট্টা ভেঙ্গে নিতে হবে।
  • সরিষার খৈল এবং নারিকেলের খৈল-ও গুড়ো করে নিতে হবে।
  • সমস্ত উপকরণ ওজন করে নিতে হবে।
  • উপকরণ মিশ্রণের স্থান পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
  • ধাপে ধাপে উপকরণগুলো একত্রে রাখার পর ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে।

ফাউমি মুরগির খাবার তালিকা

ফাউমি মূলত মিশরীয় জাতের একটি মুরগি তবে প্রকৃতপক্ষে এটি বন্য মুরগির একটি হাইব্রিড সংস্করণ। এই মুরগি ডিম দেয়ার জন্য বেশি পরিচিত। তাই অন্যান্য ডিম পাড়া মুরগির মত এই মুরগিরও খাবারের বিশেষ যত্ন নেয়া প্রয়োজন।

অন্যান্য জাতের মুরগির তুলনায় ফাউমি মুরগি পালন করা সহজ। এরা সাধারন খাদ্যেও বেশ ভালো ভাবেই বেড়ে উঠতে পারে। তবে আপনি যদি ডিম উৎপাদনের উদ্দেশ্যে এটি পালন করতে চান তাহলে খাবারের বিষয়ে বিশেষ সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত।

ফাউমি মুরগিকে সাধারনত বয়সের অনুপাতে খাবার দেয়া হয়ে থাকে। তাই খাবারের তালিকা দেওয়ার আগে চলুন বয়স অনুসারে এদের ভাগগুলো সম্পর্কে জেনে নেই-

  • ০ থেকে ৬ সপ্তাহ- স্টার্টার
  • ৭ থেকে ১৪ সপ্তাহ- গ্রোয়ার
  • ১৫ থেকে ৪৫ সপ্তাহ – লেয়ার ১
  • ৪৬ থেকে ৯৫ সপ্তাহ –লেয়ার ২

বয়স অনুযায়ী এই খাবারগুলোতে যে সব উপকরণ ব্যবহার করা হয় সেগুলো হল (আনুমানিক ১০০ কেজি খাবারের হিসাব)ঃ

  • ভুট্টা- ৫২ কেজি থেকে ৫৬ কেজি
  • সয়াবিন মিল- ২২ কেজি থেকে ২৫ কেজি
  • রাইস পালিশ- ৭.৫ কেজি থেকে ১০ কেজি
  • প্রোটিন ৬০% – ৩ কেজি থেকে ৮ কেজি
  • ঝিনুকের গুড়া- ২ কেজি থেকে ২০ কেজি
  • লবন- ২৮০ গ্রাম থেকে ৩০০ গ্রাম
  • ডিসিপি- ৫০০ গ্রাম থেকে ৩০০ গ্রাম
  • সালমোনেলা কিলার- ৩২০ গ্রাম থেকে ৩০০ গ্রাম
  • প্রিমিক্স- ৩০০ গ্রাম থেকে ২০০ গ্রাম
  • ডিএল-মিথিওনিন – ১২৫ গ্রাম থেকে ১৫০ গ্রাম
  • এল-লাইসিন – ৬০ গ্রাম থেকে ১০০ গ্রাম
  • কোলিন ক্লোরাইড – ৫০ গ্রাম থেকে ৬০ গ্রাম
  • টক্সিন বাইন্ডার – ১২৫ গ্রাম থেকে ১৫০ গ্রাম
  • সোডা – ৫০ গ্রাম থেকে ৭৫ গ্রাম (স্টার্টার ও গ্রোয়ার-এ দেয়া যাবে না)
  • সয়াবিন তেল – ১০০ গ্রাম থেকে ২০০ গ্রাম

মুরগির বয়সের অনুপাতে কমবেশি করে এই উপাদানগুলো একসাথে মিলিয়ে খাবার তৈরি করতে হবে।

ব্রয়লার মুরগির ওজন বৃদ্ধির চার্ট

আমাদের দেশের মুরগির মাংসের চাহিদার প্রায় সিংহ ভাগই পূরন হয় ব্রয়লার মুরগি থেকেই। তাই এই মুরগির চাহিদা আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি। কি খাওয়ালে মুরগির ওজন বাড়ে তা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। কিন্তু ব্রয়লার মুরগির ওজন বৃদ্ধির জন্য যে খাবার সরবরাহ করতে হবে তা অন্য জাতের মুরগির চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। তাই এবার আমরা ব্রয়লার মুরগির ওজন বৃদ্ধির চার্ট নিয়ে আলোচনা করবো।

বয়স (দিন)ওজনদৈনিক বৃদ্ধি (গ্রাম)মোট খাদ্য গ্রহন
৬২১৮১৩
১৫০২৭১০১
১০৩২৮৫২৩৪৭
১৫৫৯০৭২৬০৪
২০৯৩৩১০০১০৪৭
২৫১৩৪৪১৩০১৬৩৬
 ৩০১৮০৫১৫৮২৩৭১
৩৫২২৯৫১৮৩৩২৩৮

ব্রয়লার মুরগির ওজন দ্রুত বৃদ্ধির জন্য শুধু খাবারের উপরে নির্ভর করলেই হবে না সাথে প্রয়োজন সঠিক পরিচর্যার। তাই ভালোমানের খাবার দেয়ার পাশাপাশি, গ্রোথ প্রোমোটার (মাল্টি ভিটামিন) দিতে হবে। সেই সাথে খামার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, খামারে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে, মুরগির তাপমাত্রা সঠিক থাকতে হবে এবং সময়মত মুরগিকে টিকা দিতে হবে।  

মুরগিকে কি কি বাড়তি খাবার দিতে হয়?

বিভিন্ন জাতের মুরগির খাবার তালিকার পাশাপাশি কি খাওয়ালে মুরগির ওজন বাড়ে তা নিয়েও আমরা ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি। সাথে মুরগির প্রয়োজনীয় খাবারের তালিকা সম্পর্কেও আমরা জেনেছি। এই সব সুষম খাবারের বাইরে মুরগিকে কি আর কোন বাড়তি খাবার দেয়ার প্রয়োজন পড়ে? মুরগির বৃদ্ধির ও রোগবালাই এর নির্ভর করে বাড়তি খাবার দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়াও মুরগি যখন ডিম পাড়তে শুরু করে তখন বাড়তি খাবার দেয়ার দরকার হতে পারে। চলুন দেখি প্রয়োজন অনুসারে মুরগিকে কি কি বাড়তি খাবার দিতে হয়-  

  • হাড়ের গুড়া
  • চুনা পাথর
  • গ্রোথ প্রোমোটার বা মাল্টি ভিটামিন
  • বিশুদ্ধ পানি ইত্যাদি

এছাড়াও বাজারে মুরগির জাত, বয়স ও উদ্দেশ্য (মাংস উৎপাদন, ডিম উৎপাদন) ইত্যাদির উপর নির্ভর করে পাউডার, দানাদার ও বড়ি আকারে নানারকম পুষ্টিকর খাবার কিনতে পাওয়া যায়। এসব খাবার প্যাকেটের নির্দেশনা অনুসারে মুরগিকে দেয়া যেতে পারে।

পরিশেষে

বর্তমানে খামারে মুরগি লালন পালন করে অনেকেই স্বয়ংসম্পূর্ন হয়েছেন। আর সঠিক পরিচর্যা করলে এই ব্যবসা অনেক লাভজনকও বটে। আমরা এই নিবন্ধে কি খাওয়ালে মুরগির ওজন বাড়ে, সোনালি, ফাউমি ও ব্রয়লার মুরগির ওজন বৃদ্ধি ও খাবার তালিকার পাশাপাশি মুরগিকে কি কি বাড়তি খাবার দিতে হয় ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আশাকরি খামারি ভাইরা এই নিবন্ধ থেকে যথেষ্ট উপকৃত হবেন। আর এই বাইরেও আরো কিছু জানার থাকলে আমাদের ইনবক্সে প্রশ্ন করতে পারেন। আমরা যথাসম্ভব উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ।  

Leave a Reply