কি খেলে লিভার পরিষ্কার হয়? আসুন জেনে নেই

কি খেলে লিভার পরিষ্কার হয়? আপনি জানেন কী লিভার রোগ কি? কি খেলে লিভার পরিস্কার হয় অথবা কোন ব্যায়ামগুলো লিভারকে ভালো রাখতে পারে? 

লিভার হল আমাদের দেহের সবচেয়ে বড় গ্রন্থি এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একটি অভ্যান্তরীন অঙ্গ। এটি শরীরের ডান দিকে থাকে। মানব শরীর সচল রাখতে লিভারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন কাজ রয়েছে যেমন এটি পিত্ত নামক একধরনের তরল উৎপাদন করে যা হজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।

লিভারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়া। লিভার কোন সমস্যার কারনে কাজ করা বন্ধ করলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমরা অনেকেই এই অতি গুরুত্বপূর্ন অঙ্গটির সুস্থতা নিয়ে সচেতন না। তাই আজকে আমরা লিভারের নানা রকম সমস্যা ও কীভাবে সেগুলো থেকে বাঁচা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

কি খেলে লিভার পরিষ্কার হয়

কি খেলে লিভার পরিষ্কার হয় এবং লিভার রোগ কি?

লিভার রোগের খুব সাধারন কারণ হল হেপাটাইটিস ভাইরাস। এর সংক্রমনে লিভার মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়াও ইমিউন সিস্টেমে সমস্যা, অতিরিক্ত মদ্যপান করা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অতিরিক্ত তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার খাওয়া, দীর্ঘদিন ধরে সেবন করা কোন ঔষধের পার্শপ্রতিক্রিয়া, ক্যান্সার বা অন্যান্য কোষের বৃদ্ধি ইত্যাদি কারনে লিভারে নানারকম রোগের সৃষ্টি হতে পারে।   

লিভারের বিভিন্ন রোগগুলো হলঃ

১. জন্ডিসঃ লিভার সবচেয়ে বেশী যে রোগে আক্রান্ত হয় তা হল জন্ডিস। জন্ডিস সাধারনত নবজাতক ও শিশুদের মধ্যে বেশী দেখা যায় তবে এই রোগ বড়দেরও হয়ে থাকে। হলুদ চোখ এবং হলুদ ত্বক দেখে এই রোগ সনাক্ত করা যায়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে জটিলতা বৃদ্ধি পেতে পারে। 

২. লিভার ক্যান্সারঃ ক্যান্সার মানেই ভয়াবহ কিছু আর সেটা যদি লিভারে হয় তাহলে তো কথায় নাই। লিভারে যদি ম্যালিগন্যান্ট টিউমার তৈরি হয় বা ক্যান্সারের টিস্যু তৈরি হয় তাহলে সেই অবস্থাকে মূলত লিভার ক্যান্সার বলে।  

৩. হেপাটাইটিসঃ সংক্রমণের কারনে মূলত হেপাটাইটিসের মত মারাত্বক রোগ হতে পারে। হেপাটাইটিস পাঁচ প্রকারের হতে পারেঃ

  • হেপাটাইটিস এ- এটি দুষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
  • হেপাটাইটিস বি- এটি ভাইরাসের সংক্রমণের মাধ্যমে ছড়ায়।
  • হেপাটাইটিস সি- হেপাটাইটিস সি তে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে আছেন এমন ব্যক্তির রক্তের সংস্পর্শে ছড়ায়। 
  • হেপাটাইটিস ডি- এটি মূলত হেপাটাইটিস বি এ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বিকশিত হয় এবং গুরুতর রূপ নেয়। 
  • হেপাটাইটিস ই- এই সমস্যা দুষিত পানি পানের মাধ্যমে হতে পারে। 

৪. লিভার সিরোসিসঃ লিভারের মারাত্বক রোগগুলোর একটি হল লিভার সিরোসিস। লিভারে ফাইবরাস টিস্যু তৈরি হলে এই রোগের সৃষ্টি হয়। 

৫. ফ্যাটি লিভারঃ অস্বাস্থ্যকর খাবার, অতিরিক্ত তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার, অত্যধিক অ্যালকোহল সেবন ইত্যাদি কারনে লিভারে ফ্যাট জমতে পারে। 

৬. লিভার ফেইলিওরঃ ফেইলিওর মানে হল লিভার কাজ করতে না পারা। কোন রোগে বা অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রভাবে লিভার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 

৭. জেনেটিক- এছাড়াও পিতা বা মাতা অথবা উভয়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত কোন অস্বাভাবিক জিন এর কারনে লিভারে সমস্যা হতে পারে।

আরো পড়ুন:

লিভারের সমস্যা হলে কিভাবে বুঝব?

আমাদের দেহঘড়ি নিয়ম মেনে চলে। এই নিয়মের কোথাও কোন ব্যতিক্রম হলে আমরা ধরে নেই যে কোথাও কোন সমস্যা হয়েছে। এই ব্যতিক্রম ঘটনাগুলোকেই কোন সমস্যা বা রোগের লক্ষন বা উপসর্গ বলা যেতে পারে। আপনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই ব্যতিক্রম বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করতে পারলে ও সে অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা নিলে দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে পারবেন।

খাওয়ার আগ্রহ কমে গেলে বা বমির ভাব হলে লিভার নিয়ে সচেতন হওয়া জরুরী। এছাড়া পাকস্থলীর কোন সমস্যাও লিভার রোগের সংকেত হতে পারে। খাওয়ার পর পেট ফুলে ওঠা, বা জ্বালা যন্ত্রনা হলে অথবা পেট ভারী মনে হলে লিভারে কোন সমস্যা হল কিনা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। 

লিভার রোগের প্রাথমিক লক্ষণ কি?

লিভার রোগের প্রাথমিক কিছু লক্ষন হল পেটে ব্যাথা করা, ক্ষুধামন্দা, ক্লান্ত থাকা বা কাজে শক্তি না পাওয়া, ডায়রিয়া ইত্যাদি। তবে এই সমস্যাগুলো এত বেশী সাধারন যে বেশীরভাগ মানুষই এদের গুরুত্বের সাথে ধরেন না। তবে এগুলো ছাড়াও আরো কিছু বিশেষ লক্ষন আছে যেগুলো লিভার রোগের সংকেত দেয়। চলুন দেখি সেগুলো কি কি-

১. চোখ ও ত্বকের রঙ হলুদ হয়ে গেলে সেটা জন্ডিসের লক্ষন। লিভার যখন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না তখন রক্তে বিলিরুবিন নামক একটি হলুদ পদার্থ পরিস্কার করতে পারে না। ফলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা অনেক বেশী বেড়ে যায়।

২. ত্বকে চুলকানি মানেই তা কিন্তু এলার্জি জনিত সমস্যা নয়। লিভারে দীর্ঘমেয়াদি কোন রোগে ভুগলে ত্বকে চুলকানি হতে পারে। ত্বকে কোন র‍্যাস বা ফুসকুড়ি না থাকলেও চুলকানি হতে পারে। এমনকি এই অসস্তিকর সমস্যার কারনে ঘুমের ব্যাঘাতও ঘটতে পারে। 

৩. কোন কারণ ছাড়াই যদি আপনার পেট ফুলে উঠে তাহলে সচেতন হোন। কারণ লিভারে সঠিকভাবে রক্ত প্রবাহিত হতে না পারলে তার চারপাশের রক্ত নালীতে চাপ বেড়ে যায়। তাই পেট বড় হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখা যাবে না।

৪. পা ও পায়ের গোড়ালি লিভার রোগের আরো একটি বিশেষ লক্ষন। শরীরের এই অংশগুলোতে তরল জমা হয় তাই ফুলে ওঠে। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

৫. মলের রঙ ফ্যাকাশে হলে এবং প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলে সতর্ক হতে হবে। কেননা মলের রঙ ফ্যাকাশে হলে তা লিভার রোগের সংকেত দেয়। বিশেষকরে জন্ডিস হলে এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

৬. আপনি কী প্রায়শই ক্লান্তিতে ভোগেন? তাহলে আপনার লিভার একজন বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন। কেননা শরীর থেকে যদি কোন কারনে টক্সিন নিষ্কাশিত হতে না পারে তাহলে রক্তে বিষাক্ত পদার্থের পরিমান বেড়ে যায়। আর এর প্রভাব মস্তিষ্কেও পড়ে। 

৭. লিভার ঠিকমত কাজ না করলে শরীরে টক্সিনের পরিমান বেড়ে যায়। ফলে পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আপনার যদি ঘন ঘন পেটের সমস্যা লেগেই থাকে তাহলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কেননা লিভারের কার্যকারিতা একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে বমি বমি ভাব ও মলের সাথে রক্তপাতও হতে পারে।

লিভারের জন্য ক্ষতিকর খাবার

দিন দিন আমাদের দেশে লিভার রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। এর পেছনে দায়ী আমাদের কিছু বাজে অভ্যাস। আমাদের বাঙ্গালীদের শরীরচর্চায় অনেক বেশী অনীহা, খাবারেও রয়েছে মারাত্বক রকমের অনিয়ম। ফলস্বরূপ চল্লিশের কোঠা না পেরুতেই নানারকম জটিল রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে। বিশেষ কিছু খাবার রয়েছে যা আমাদের লিভারের জন্য ক্ষতিকর। চলুন দেখি সেগুলো কি কি-

১. বেক করা খাবার আমাদের লিভারের জন্য ক্ষতিকর। যেমন- কেক, কুকিজ, পেস্ট্রি, পাউরুটি ইত্যাদি। এই খাবারগুলো একেবারে বাদ দিতে না পারলেও কমাতে হবে অবশ্যই। 

২. রাস্তার ধারের খোলা হোটেলের পোড়া তেলে ভাজা খাবার যেমন সিঙ্গারা, সমুচা, চপ, পিয়াজু ইত্যাদি খাবার প্রচুর পরিমানে তেল থাকে। এই খাবারগুলো ফ্যাটি লিভার সহ আরও নানারকম রোগের জন্য দায়ী।  

৩. মদ্যপান লিভারের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। শুধু অ্যালকোহলই নয়, বাজারে প্রাপ্ত নানারকম কোমল পানীয়, সোডা ইত্যাদিও আমাদের লিভারের জন্য ক্ষতিকর। তাই লিভারকে সুস্থ রাখতে অতি অবশ্যই মদ্যপান পরিহার করুন। 

৪. অতিরিক্ত মাত্রায় চিনি খাওয়াও লিভারের জন্য ক্ষতিকর। সাদা চিনিকে পুষ্টিবিদেরা বিষের সাথে তুলনা করেন। তাই সরাসরি চিনি তো বটেই সেই সাথে চিনির তৈরি খাবারও লিভারের জন্য ক্ষতিকর।

৫. যদিও আমরা কমবেশী সবাই ময়দার তৈরি খাবার খাই। রুটি, পরটা, লুচি থেকে শুরু করে নুডুলস, পাস্তা ইত্যাদি আমাদের রোজকার খাবার। তবে এই প্রক্রিয়াজাত ময়দা আমাদের লিভারের জন্য মোটেও ভালো নয়।

কি খেলে লিভার পরিষ্কার হয়?

খামখেয়ালী ভাবে চলে আর অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে লিভার দূষিত করে ফেলেছেন? অসুবিধা নেই, জেনে নিন কি খেলে লিভার পরিস্কার হয়-

১. সবুজ শাক: সবুজ রঙ্গের শাকে প্রচুর পরিমানে ক্লোরোফিল থাকে যা আমাদের রক্ত থেকে দূষিত পদার্থ শোষণ করে রক্ত বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে। এটি হজম শক্তি বৃদ্ধি করে তাই লিভারও ভালো থাকে। 

২. লেবু জাতীয় ফল: লেবু জাতীয় ফল যেমন কমলালেবু, জাম্বুরা লেবু ইত্যাদি ফল লিভার থেকে দূষিত পদার্থ বের করতে পারে। তাই যে কোন সাইট্রাস ফল, কিসমিস, ব্লুবেরি ইত্যাদি খেতে পারেন। লেবুতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিভারে প্রদাহ কমাতেও সাহায্য করে।  

৩. হলুদ: হলুদে কারকিউমিন নামক এক ধরনের উপাদান থাকে যেটা লিভারের কোষগুলোকে ভালো রাখে। এছাড়াও হলুদের আরো অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। 

৪. বিটরুট: বিটরুটে প্রচুর পরিমানে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা বেটেলের নামে পরিচিত। বিটরুটের রস নিয়মিত খেলে লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়।

৫. আদা: আদায় সেলেনিয়াম নামক এক ধরনের উপাদান থাকে যা আমাদের শরীর থেকে উৎসেচক বের করে দিয়ে লিভার পরিস্কার রাখে। 

৬. অলিভ অয়েল. অলিভ অয়েল আমাদের শরীরে কিছু এনজাইম বাড়িয়ে দিতে পারে যেগুলো লিভার থেকে দূষিত পদার্থ বের করতে সাহায্য করে।

লিভার বড় হলে কি কি সমস্যা হয়?

লিভার বড় হয়ে যাওয়া অবশ্যই অনেক বড় একটা সমস্যা। নানাবিধ শারীরিক সমস্যার কারনে লিভার বড় হয়ে যেতে পারে। এই অঙ্গটি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে গেলে নানারকম সমস্যা হতে পারে যেমন-

  • ত্বক এবং চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া
  •  পেটে ব্যথা, ফুলে যাওয়া বা ফোলাভাব 
  • ডায়রিয়া, 
  • ফ্যাকাশে রঙের মল, বা রক্তাক্ত মল (মল লাল বা কালো হতে পারে) 
  • বমি বমি ভাব বা বমি 
  • শ্বাস নিতে অসুবিধা 
  • বিবর্ণ প্রস্রাব 
  • ক্লান্তি, জ্বর বা সর্দি মাথাব্যথা
  • ক্ষুধার অভাব এবং অনিচ্ছাকৃত ওজন হ্রাস 
  • পা ফুলে যাওয়া

লিভার বড় হয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় সমস্যা তবে রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে তা সেরে যেতে পারে।

আরো পড়ুন:

লিভার ভালো রাখার ব্যায়াম

লিভারের নানারকম সমস্যার বিষয়ে আমরা জানলাম। এখন চলুন দেখি কোন ব্যায়ামগুলো আমাদের লিভারকে ভালো রাখতে পারে।

১. হাটা: হাটা এমন একটি ব্যায়াম যা কেবল লিভারকেই নয়, আমাদের শরীরের সার্বিক উন্নতির জন্য খুবই কার্যকর। সবচেয়ে সহজ এই ব্যায়ামটি প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করলে শরীর ভালো থাকে। 

২. দৌড়ানো হাটার চেয়ে দৌড়ানো লিভারের জন্য আরও বেশী কার্যকর। খোলা ময়দানে অথবা ঘরের ভেতর ট্রেডমিলে সপ্তাহে ৩/৪ দিন ৩০ মিনিট দৌড়াতে পারেন। 

৩. সাঁতার কাটা: সাঁতার কাটা এমন একটি ব্যায়াম যার দ্বারা পুরো শরীরের ব্যায়াম হয়ে যায়। তাই লিভার ভালো রাখতে সপ্তাহে ৩ দিন আধা ঘন্টা করে সাঁতার কাটতে পারেন।

৪. সাইকেল চালানো: নিয়মিত সাইকেল চালানোর মাধ্যমেও লিভার ভালো রাখা যায়।

সারসংক্ষেপ

বিভিন্ন রকম রোগ, রোগের লক্ষন ইত্যাদির পাশাপাশী কি খেলে লিভার পরিস্কার হয় তা নিয়ে আজকে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আশাকরি, এই আলোচনা থেকে লিভারের নানারকম সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারলেন এবং এই অতি গুরুত্বপূর্ন অংগটিকে কীভাবে ভালো রাখা যায় সে সম্পর্কে জানতে পারলেন। তাই আর দেরি না করে এখনি সচেতন হোন, আপনার লিভারকে ভালো রাখুন, সুস্থ জীবন যাপন করুন।

Leave a Reply